আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণেই শিশুর প্রতি নৃশংসতা বাড়ছে

1436688001// আতিক আজিজ //  
সাড়ে তিন বছরে দেশে ৯৬৮জন শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৪ সালে শিশু হত্যার হার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি ছিল। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ২৬৭টি সংগঠনের মোর্চা শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১২ সালে ২০৯,২০১৩ সালে ২১৮, ২০১৫ সালে ৩৫০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের সাত মাসেই ১৯১ জন শিশুকে হত্যা করা হয়।
শিশুর প্রতি নৃশংসতা কেন?আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণেই সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুর প্রতি নৃশংসতা ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে সব শিশু নির্মমতার বা খুনের শিকার হচ্ছে তারা অধিকাংশেই গ্রামীণ,সমাজের পথশিশু এবং বিভিন্ন শ্রম ও গৃহকর্মের সঙ্গে জড়িত। এ শিশুরা অসহায় হওয়ায় এবং তাদের সঙ্গে কোনো অভিভাবক না থাকায় তাদের যারা কাজ দিয়েছে তারা বিভিন্ন কারণে নিজেদের হতাশা ক্ষোভ ঝেড়ে শিশুদেরকে হত্যা করছে। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের প্রবল অবক্ষয়ের কারণে এখন শিশুদের এ ভয়াবহ নৃশংস খুনের শিকার হতে হচ্ছে।

অস্বচ্ছল মানুষ এক সঙ্গে গাদাগাদি করে ছোট জায়গায় থাকছে। ফলে মানুষের মনের পরিশুদ্ধ হওয়ার উপায় নেই। নেই চিত্ত বিনোদনের সুযোগও। এর ফলে মানুষের বিকৃতি বাড়ছে। তাদের কোমল অনুভূতি চলে যাচ্ছে। তারা ক্রমেই পাশবিক হয়ে শিশু হত্যা করছে। সমাজে ঘুষ দুর্নীতি বেড়ে গেছে। আমরা ধর্ম থেকে সরে ধর্মতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। বিশ্ব মিডিয়ায় আমাদের অপসংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল আমাদের সহিংসতা শেখাচ্ছে। এমনকি বাচ্চাদের কার্টুনেও সহিংসতা শেখানো হচ্ছে। শিশু খুনের অপরাধে কঠিন শাস্তির জায়গায় থেকে সরে যাওয়ায় এতে ঘনঘন শিশু খুনের ঘটনা ঘটছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সহ নানা প্রকার প্রভাব খাটিয়ে কিছু মানুষ শিশু খুনের মতো জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে। রাষ্ট্র প্রতিটি শিশু খুনের ঘটনায় তাদের ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারিনি বলেই শিশু খুনের ঘটনা ঘটছে।

শিশু খুনের এ ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রতিরোধে সবার আগে আইন প্রণেতাদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশু হত্যার ব্যাপারে রাজনৈতিক ভাবে সরকারকে নিজের জিরো টলারেন্সে যেতে হবে।

হত্যাকারীদের প্রতিরোধে কঠোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি দ্রুত বিচারে এ মুহুর্তে ১৫/২০ জন হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বা ফাঁসির দেয়া যায় তবে এ নির্মমতা কমে আসবে। সমাজ ও রাষ্ট্র যে বিচারহীনতা সহ্য করেনা তা প্রমাণ করতে হবে। যারা শিশু হত্যায় লিপ্ত তাদের পরিচয় সে যেই হোক না কেন প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার করে তার দন্ড দিতে পারলে আমাদের বিচার বিভাগ, আইনের শাসন আদালতের প্রতি আস্থা থাকবে এবং অপরাধ কমে আসবে। যাদের দায়িত্ব মানুষের নীতি শেখানো তাদেরও আত্বশুদ্ধির প্রয়োজন আছে। এর পাশাপাশি পরিবার প্রধানদের সুনীতির জায়গায় থাকতে হবে।

শিশু হত্যার এ ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে আমাদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে স্কুল পরিবার ও সমাজে চলমান প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। প্রচার মাধ্যমকে হতে হবে দায়িত্বশীল। সহিংসতা বা হিংস্রতার সংবাদ এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে যাতে হিংস আচরনকারী কখনোই হিরো হয়ে না ওঠে।

রাতারাতি ধনী হওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এজন্য দরকার দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা। সমাজকে এজন্য স্থিতিশীল করতে হবে। শিশু হত্যা ও নির্যাতন বন্ধে সমাজের সব মানুষের অংশ গ্রহণ প্রয়োজন।
সিলেটের ১৩ বছরের শিশু শেখ মোঃ সামিউল আলম ওরফে রাজনের নৃশংস হত্যাকান্ড গোটা জাতিকে ভীষণ ভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। অনেকের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় আইন প্রয়োগের ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা ও হতাশার প্রকাশ ঘটেছে। এ ঘটনার ১ মাসের ব্যবধানে ঘটে গেছে আরো একাধিক নৃশংস এমন হত্যাকান্ড । উদাহরণস্বরূপ গত ৪আগষ্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে সুটকেসের ভেতর থাকা একটি মেয়ে শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।খুলনার নির্যাতনের শিকার হওয়া ১২ বছর বয়সী রাকিব গ্যারেজ পরিবর্তন করায় তার মলদ্বার দিয়ে মোটর সাইকেলের চাকার হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসার মেশিনের নল দিয়ে পেটে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় রাকিবকে।বড়গুনার রবিউল আউয়াল নামে ১১ বছরের এক শিশুকে চোখে আঘাত করে মাছ চুরির অভিযোগে স্থানীয় এক ব্যক্তি এই ভীভৎস কায়দায় তাকে হত্যা করে।

বর্তমানে যেসব নৃশংস শিশু হত্যা কান্ডের ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ন্ত্রনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে। এই নৃশংস প্রতিটি শিশু হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত বিচার ও শিশু হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করায় মধ্য দিয়েই শুধু নৃশংস শিশু হত্যা কান্ড কমানো সম্ভব হতে পারে।
————————————————–
লেখক : চেয়ারম্যান- জাতীয় পরিবেশ মানবাধিকার সোসাইটি (গভ:রেজি:নং এস-৮৯১৩)।
সম্পাদক – সাপ্তাহিক আমারকণ্ঠ
২৮,কারওয়ান বাজার,তাজ ম্যানসন (৪র্থ তলা) ঢাকা-১২১৫।
মোবাইল – ০১৯১১৬৮৮৬৭৭, ০১৮১৮৬৮৩৮৩১

Posted on August 16, 2015, in মুক্তমত. Bookmark the permalink. Leave a comment.

Leave a comment